মো. মাহবুবুর রহমান
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড।আর শিক্ষক হচ্ছে শিক্ষার মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড না থাকলে যেমন কোন প্রাণী সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। আমরা উন্নত দেশসমূহের দিকে তাকালে দেখতে পাই, যে সকল দেশ শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন, কেবলমাত্র সে সকল দেশই উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেছে। আর যারা শিক্ষাখাতকে কম গুরুত্ব দিয়েছে ,তারা উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে আছে।
বাংলাদেশ সৃষ্টির শুরু থেকেই শিক্ষাখাত অবহেলিত। বিগত সরকারের নৈরাজ্যের কারণে শিক্ষাখাতের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যাসমূহ আজ চরম জঞ্জালে রূপান্তরিত হয়েছে। যা প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের নিয়ে শিক্ষা সংস্কার কমিটি গঠন করে দ্রুত সমাধান করা সময়ের দাবি । বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকরা বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বারবার সরকারের কাছে দাবি তুলে ধরেছে । বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার শিক্ষকদের দাবির প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ব্যবহার করে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবির আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করেছেন। আবার কখনো কখনো কৌশলের মাধ্যমে তাদের ন্যায্য দাবিসমূহ মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে পরবর্তীতে মানা হয় নাই ।বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিদায়ের পর প্রত্যাশা ছিল, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বিশ্ববরেণ্য প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস এর নেতৃত্বে গঠিত সরকার বহুদিনের সৃষ্ট বিভিন্ন জঞ্জাল অপসারণ ও রাষ্ট্র কাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার করে বিশ্বের বুকে নতুন করে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করবেন। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো। রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত করার জন্য প্রথমত ছয়টি কমিশন গঠন করা হলো। পরবর্তীতে আরো পাঁচটি। আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করলাম সর্বাগ্রে যে কমিশনটা গঠিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল সেটাই হলো না। আমি শিক্ষা কমিশনের কথা বলছি। যত কমিশনই গঠন হোক না কেন শিক্ষা কমিশন বাদ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার বা সমস্যার সমাধান সম্ভব না। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন শিক্ষা সংস্কারের বিষয়ে কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ পেশ করেছেন। যেগুলো শিক্ষার প্রকৃত ও টেকসই উন্নয়নের জন্য যথেষ্ঠ নয়। শিক্ষা খাতের সুপারিশমালা পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বাস্তবায়নের জন্য প্রতিটি স্তরের জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীগণের সন্তানদের নিজ নিজ কর্ম এলাকায় অবস্থিত স্কুল -কলেজ এ পড়ালেখার ব্যবস্থা করলে তারা স্কুল -কলেজ এর উন্নয়ন ও নজরদারিতে আরো সচেষ্ট হবেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে । ১৯৯০ সালে ও রক্ত দিয়ে এদেশের জনগণ স্বৈরাচারকে বিদায় করেছে।পুনরায় বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে ২০২৪ সালে ছাত্র- শ্রমিক – জনতা এক হয়ে তাদের বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়ে একটানা ১৭বছর ধরে বাংলাদেশের জনগণের বুকের উপর জগদ্দল পাথরের মত বসে থাকা অবৈধ ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় জানিয়েছেন।জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারলে,বারবার প্রাণ বিসর্জন দিয়েও বহুল প্রত্যাশিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর কত রক্ত গঙ্গা বইলে এ জাতি বৈষম্য থেকে চিরতরে মুক্তি পাবে? আমাদের মায়ের কোল খালি হওয়া এবং রক্তদানের হাত থেকে এ জাতিকে বাঁচাতে হলে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে শিক্ষা খাতে দ্রুত সংস্কারের পদক্ষেপ নিতে হবে এবং তা অনতিবিলম্বে বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে প্রত্যাশা রাখি।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সমস্ত শ্রেণী পেশার মানুষের প্রত্যাশা অনেক।কারণ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের ফসল এই সরকার। সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা এই সরকার সংস্কার করে একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিবেন যাতে ভবিষ্যতে একটি জনবান্ধব সরকার গঠিত হয় এবং তারা সংস্কার কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন করে একটি সভ্য ও সুশিক্ষিত জাতি গঠনে কাজ করতে পারে। সভ্য ও শিক্ষিত জাতি গঠনের জন্য প্রতি বছর জিডিপি’র উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে হবে। শুধু অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দিলে চলবে না। যদি আমরা অবকাঠামোকে হার্ডওয়ারের সাথে তুলনা করি, তাহলে শিক্ষক হল তার সফটওয়্যার। তাই সফটওয়্যার উন্নয়ন ব্যতীত শুধু অবকাঠামো উন্নয়নের চিন্তা করলে প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জন করা অসম্ভব। বিদ্যমান শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে মান উন্নয়ন করতে হবে যাতে তারা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভালো পাঠদান করতে পারেন। রাজনৈতিক সরকার গুলো অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। কারণ অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেদের এবং তাদের অনুগতদের জন্য ফায়দা লুটা সম্ভব।এই হালুয়া রুটির ভাগাভাগিতে শিক্ষাখাত আজ জঞ্জালে রূপান্তর হয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ।বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধায় ভালো ফলাফল ধারি ছাত্র ছাত্রীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে অনাগ্রহী। তাই শিক্ষাকে ধ্বংসের কবল থেকে বাঁচাতে হলে এখনই শিক্ষকদের জন্য আকর্ষণীয় বেতন ও ভাতাদি বৃদ্ধি করে তাদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক দৃষ্টি দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে ভালো ফলাফল ধারী মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী পছন্দের মর্যাদাপূর্ণ পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নেয়। আলাদা বেতন কাঠামো তৈরি করে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে এই মর্যাদাপূর্ণ পেশার প্রতি আকৃষ্ট করতে পারলে তারা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিশ্বমানের আধুনিক শিক্ষা দানের মাধ্যমে জ্ঞান বিজ্ঞানে তথা দক্ষ মানবসম্পদে উন্নীত করতে পারবেন। তাহলেই এ জাতি শিক্ষা দীক্ষায় অগ্রসর হয়ে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে সারা বিশ্বে অবদান রাখতে পারবেন।সঠিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে সুনাগরিক গড়তে পারলে এদেশে গুণী লোকদের কদর বাড়বে এবং দুর্নীতিবাজরা সমাজের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। ভবিষ্যতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতিটি ক্ষেত্রে অধিষ্ঠিত হয়ে শক্ত হাতে হাল ধরবে। তাদের নেতৃত্বেই সোনার বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হবে সুশাসন এবং বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দুর্বার গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
লেখক : মো. মাহবুবুর রহমান
সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ।
ফরিদপুর সিটি কলেজ।
Leave a Reply