রবিবার, ০৩ অগাস্ট ২০২৫, ০১:৫৬ অপরাহ্ন
সর্বশেষ সংবাদ :
বোচাগঞ্জে হারিয়ে যাওয়া অস্ত্র-গুলি উদ্ধার অভিযান অব্যাহত, ওসির বক্তব্যে প্রশ্ন উঠছে বোচাগঞ্জে মডেল মসজিদ নির্মাণে অনিয়ম: গাঁথুনির কাজ স্থগিতের নির্দেশ সাংবাদিক ইউনিয়ন দিনাজপুর নির্বাচন: সভাপতি ও সম্পাদক পদে তিন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল কাহারোলে নিষিদ্ধ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ২ কর্মী আট বিএমবিসি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নে অভিভাবক সমাবেশ  বালিয়াকান্দিতে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত, নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সালথা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক শাহিন গ্রেপ্তার চরভদ্রাসনে মেধাবৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠান সম্পন্ন বালিয়াকান্দি পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করলেন এসিল্যান্ড বিএনপির সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কর্মসূচির উদ্বোধন

মে দিবস ২০২৫ : বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকার ও বাস্তবতা

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫, ৮.২৬ এএম
  • ১৯৯ জন সংবাদটি পড়েছেন

মো. মাহবুবুর রহমান

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট :
১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ‘হে মার্কেটের’ ঘটনাই তাঁদের আত্মত্যাগের স্মারক হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কংগ্রেস ১ মে দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে বিশ্ব জুড়ে ‘মে দিবস’ পালিত হয়ে আসছে শ্রমিক অধিকারের প্রতীক হিসেবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মে দিবস :
বাংলাদেশে মে দিবস সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও এনজিও র‌্যালি, সেমিনার এবং আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকে। তবে বাস্তবে শ্রমিকদের অধিকারের বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়, বিশেষ করে বেসরকারি খাতে।
২০২৪ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ওখঙ)-এর ৩৫০তম অধিবেশনে বাংলাদেশের শ্রম পরিবেশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের স্বাধীনতা, শ্রমিক হয়রানি এবং ন্যায্য মজুরি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। অন্যদিকে, চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশের শ্রম উন্নয়নের প্রচেষ্টার প্রশংসা করে।
গবেষণা ও নীতিগত অগ্রগতি :
সরকার ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন। নতুন আইনে ১২০ দিনের মাতৃত্বকালীন ছুটি, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে বাধা দূরীকরণ, ওভারটাইমের সীমাবদ্ধতা এবং কর্মস্থলে নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
গার্মেন্টস সেক্টর :
বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত। সরকার ২০২৩ সালের শেষদিকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য নতুন ন্যূনতম মজুরি ১২,৫০০ টাকা নির্ধারণ করেছে, যা আগে ছিল ৮,০০০ টাকা। এটি অগ্রগতি হলেও শ্রমিক সংগঠনগুলোর মতে, বর্তমান বাজার দামে এই মজুরি জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট নয়। তাঁদের দাবি ন্যূনতম ২৩,০০০ টাকা।
ওখঙ-এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভারতে গার্মেন্টস শ্রমিকের গড় মাসিক মজুরি প্রায় ১৫,০০০ রুপি। তবে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় কিছুটা কম হলেও ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম ভারতে তুলনামূলকভাবে বেশি কার্যকর, যা শ্রমিকদের দাবি আদায়ে সহায়ক।
লোকাল এনজিও :
টিআইবি, ব্র্যাক ও আশা’র মতো বড় এনজিওগুলো তুলনামূলকভাবে শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করলেও ছোট ও মাঝারি এনজিওগুলোতে নিয়মিত ছুটি, স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ এখনও অনেক জায়গায় অনুপস্থিত। নিয়োগ চুক্তির স্বচ্ছতা ও বেতনসংক্রান্ত অস্পষ্টতা এখানকার বড় চ্যালেঞ্জ। টিআইবি এবং ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী সুরক্ষা নীতিমালায় ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য পথপ্রদর্শক হতে পারে।
নির্মাণ ও পরিবহন খাত :
নির্মাণ খাতের শ্রমিকরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন। নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাব, সময়সীমার অনিয়ম এবং দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ না থাকায় সমস্যা প্রকট।
পরিবহন খাতের শ্রমিকেরা দিনে গড়ে ১২–১৪ ঘণ্টা কাজ করেন। তাঁরা ন্যায্য মজুরি, ছুটি বা স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা পান না। মে দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন দাবি জানালেও বাস্তবায়নের অগ্রগতি আশানুরূপ নয়।
দোকানপাটের কর্মচারী :
দোকান কর্মচারীদের সপ্তাহে ৭ দিন, দিনে ১০–১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। অনেক দোকানে ছুটি, ওভারটাইম, মাতৃত্বকালীন ছুটি বা চিকিৎসা সেবার কোনো ব্যবস্থাই নেই। এমনকি মে দিবসেও তাঁদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এই খাতে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় শ্রমিকেরা অধিকার থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক তুলনা ও চ্যালেঞ্জ :
ওখঙ-এর মতে, বাংলাদেশে শ্রম আইনের সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান। তবে এর বাস্তবায়নই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভারতের অনেক রাজ্যে শ্রমিকদের জন্য কল্যাণ বোর্ড এবং আইনি সহায়তার নির্দিষ্ট কাঠামো রয়েছে। নেপালেও ট্রেড ইউনিয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে সংগঠিত।
আইএলও’র সুপারিশ ও আমার ভাবনা:
১. শ্রমিকদের ন্যূনতম জীবনমান নিশ্চিত করতে একটি বাস্তবভিত্তিক “জীবনযাপনযোগ্য মজুরি (খরারহম ডধমব)” নির্ধারণ এবং প্রতি দুই বছর পরপর তা হালনাগাদ করার বাধ্যতামূলক নীতিমালা প্রণয়ন।
২. শ্রমিকদের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য একটি স্বাধীন ও কার্যকর শ্রমিক অধিকার তদারকি কমিশন গঠন।
৩. শ্রমবান্ধব প্রতিষ্ঠানের জন্য কর রেয়াত ও সরকারি স্বীকৃতি প্রদান।
৪. ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে আইনগত সহায়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
৫. দোকান ও ক্ষুদ্র ব্যবসার শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি বিশেষ শ্রমনীতি তৈরি।
৬. শ্রমিকদের জন্য মোবাইলভিত্তিক ডিজিটাল অভিযোগ প্ল্যাটফর্ম চালু করা।
৭. এনজিও খাতে চাকরির চুক্তিপত্র বাধ্যতামূলক করা এবং শ্রমিক ছুটি ও নিরাপত্তার জন্য নজরদারি সংস্থা সক্রিয় রাখা।
মে দিবস কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়—এটি শ্রমিকের বাস্তব অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি প্রতীক। এই চেতনাকে কাজে লাগিয়ে শ্রমিক-নিয়োগকর্তা ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটি সমঝোতাপূর্ণ, মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলাই সময়ের দাবি।
শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের সুরক্ষা কেবল নীতিনির্ধারণে সীমাবদ্ধ না রেখে তার কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতেই হবে। সামগ্রিক উন্নয়নের পথে শ্রমিক কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিলে তবেই টেকসই অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব হবে। মে দিবস হোক আমাদের সক্রিয় প্রতিশ্রুতির প্রতিচ্ছবি।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

jmitsolution_16012
© All rights reserved © 2025
Developed By : JM IT SOLUTION