আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণার প্রাক্কালে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এবং তার বাস্তবায়ন পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে। সরকারের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ রূপকল্পের অংশ হিসেবে ‘স্মার্ট ক্লাসরুম’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেয়া হলেও, শিক্ষাবিদ ও নীতিনির্ধারক মহলে উঠছে একটি মৌলিক প্রশ্ন-শ্রেণিকক্ষ কি প্রযুক্তি দিয়ে স্মার্ট হয়, নাকি শিক্ষকের চিন্তা, মূল্যবোধ ও দক্ষতাই শিক্ষার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে?
সরকারের পরিকল্পনা : দূরশিক্ষণ সক্ষম আধুনিক ক্লাসরুম
১ মে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে অনুষ্ঠিত ‘বঞ্চিত মেয়েদের শিক্ষা উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি সম্মিলিত প্রচেষ্টা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের বলেন, “শ্রেণিকক্ষে কেবল স্মার্ট বোর্ড বসালেই স্মার্ট ক্লাসরুম হয় না। সরকার এমন একটি আধুনিক ক্লাসরুম ব্যবস্থা তৈরি করতে চায়, যেখানে শিক্ষকরা লন্ডন থেকেও ক্লাস নিতে পারবেন।” তিনি আরও বলেন, “শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক করার লক্ষ্যে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কোনো মেয়ে যেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটাই সরকারের অঙ্গীকার।”
প্রযুক্তি নির্ভর উন্নয়ন : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ
এই উচ্চাভিলাষী ঘোষণার বিপরীতে শিক্ষাবিদরা প্রশ্ন তুলছেন-এত প্রযুক্তি, এত প্রকল্প, কিন্তু শিক্ষক কোথায়? দক্ষ শিক্ষক, মর্যাদাপূর্ণ পেশা এবং মানবিক শিক্ষা পরিবেশ ছাড়া প্রযুক্তির এই বিপ্লব কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সন্দেহ।
ড. কামরুল হাসান মামুনের তীব্র সমালোচনা :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন-“ভালো বেতন দিয়ে শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করার কোনো প্রকল্প নেই, অথচ প্রজেক্ট বানানো হয়েছে শিশুদের স্মার্টফোন ও ল্যাপটপমুখী করার। স্মার্ট ক্লাসরুম পরিচালনার আগে স্মার্ট শিক্ষক তৈরি করতে হবে। তার জন্য চাই ভালো বেতন ও মর্যাদা।”
তিনি আরও বলেন, “শিক্ষকদের দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন বেতন দিয়ে স্মার্ট টিভি, ল্যাপটপ, কারিকুলাম যতই দিন না কেন, কোনো লাভ হবে না। শিক্ষকদের নৈতিকতা ক্ষয়প্রাপ্ত হবে, ছাত্ররাও শিখবে সেই অনুপ্রেরণাহীনতা।”
জিডিপি’র কত শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ?
ড. মামুন প্রশ্ন তোলেন, “আগামী বাজেটে শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সেই বরাদ্দ জিডিপির কত শতাংশ? ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী জিডিপির অন্তত ৬% শিক্ষায় বরাদ্দ থাকা উচিত, অথচ গত বাজেটে তা ছিল ১.৬৯%।” তিনি মনে করেন, শুধু বাজেটের পরিমাণ নয়, বরাদ্দের গন্তব্য কোথায়-সেটি আরও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রকল্পে ব্যক্তিগত লাভের সুযোগ : মূল উন্নয়ন উপেক্ষিত
এই প্রেক্ষাপটে অনেক শিক্ষাবিদ ও সচেতন মহল মনে করেন, শিক্ষা বিভাগে অবকাঠামো উন্নয়ন বা প্রযুক্তি কেনাকাটাভিত্তিক প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ বেশি থাকে, কারণ এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত সুবিধার সুযোগ বেশি থাকে। ফলে প্রকৃত শিক্ষা উন্নয়নের অন্যতম প্রধান উপাদান-শিক্ষকের আর্থিক ও পেশাগত মর্যাদার উন্নয়ন-সেটি বারবার উপেক্ষিত থেকে যায়।
মানবিক শিক্ষক বনাম যান্ত্রিক শ্রেণিকক্ষ :
যশোর বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান এ বি এম ছাত্তার বলেন, “ভালো শিক্ষক শিক্ষার্থীর অবস্থা বুঝে প্রয়োজন অনুযায়ী পাঠদান পদ্ধতি বদলাতে পারেন, নতুন কৌশল অবলম্বন করতে পারেন। কিন্তু প্রযুক্তিনির্ভর ক্লাসরুম সেই মানবিকতা দেখাতে পারে না।”
মাঠপর্যায়ে বাস্তবতা : বোর্ড আছে, ব্যবহার জানেন না শিক্ষক
ফরিদপুরের একটি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে বলেন, “আমাদের বিদ্যালয়ে স্মার্ট কম্পিউটার ল্যাব আছে, কিন্তু অনেক শিক্ষকই তা ব্যবহার করতে জানেন না। কারণ তাদের সে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। বরং প্রকৃত দরকার ছিল শিক্ষক তৈরির পেছনে বিনিয়োগ।”
বেসরকারি শিক্ষকদের অবস্থা : বেতন ও মর্যাদার সংকট
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন, বাড়িভাড়া, উৎসবভাতা ইত্যাদি নিয়েও রয়েছে বৈষম্য এবং দীর্ঘসূত্রতা। বৈষম্যের শিকার হওয়ায় তাদের কর্মোদ্দীপনা এবং পেশাগত মর্যাদা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
একটি মানবিক শিক্ষাব্যবস্থা : স্মার্ট যন্ত্র নয়, স্মার্ট শিক্ষক চাই
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তি হতে পারে শিক্ষার সহায়ক, তবে কখনোই তা শিক্ষার মূল ভিত্তি হতে পারে না। শিক্ষার প্রাণভোমরা হচ্ছেন সেই শিক্ষক-যিনি শুধু পাঠদান করেন না, নৈতিকতা শেখান, ভাবনার খোরাক যোগান এবং একজন মানুষ গড়ে তোলে।
শিক্ষার ভবিষ্যৎ কি শুধুই ডিজিটাল পর্দার আলোয় নির্ধারিত হবে, নাকি গড়ে উঠবে এমন এক শ্রেণিকক্ষ যেখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন একজন সৃজনশীল, শ্রদ্ধাভাজন, দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন শিক্ষক?
স্মার্ট বোর্ডের আগে প্রয়োজন স্মার্ট শিক্ষক, আর তার জন্য চাই যথাযথ বিনিয়োগ, প্রশিক্ষণ, এবং মর্যাদা। প্রযুক্তি হতে পারে শিক্ষার বাহন, কিন্তু তার চালক হতে হবে মানুষকেই।
লেখক : মো. মাহবুবুর রহমান
সহ. অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ
ফরিদপুর সিটি কলেজ
Leave a Reply