মোঃ মাহবুবুর রহমান
জ্যৈষ্ঠের তপ্ত দুপুরে কাঁচা-পাকা আমের গন্ধ ভেসে আসে গ্রামবাংলার উঠোন থেকে শহরের পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত। পাকা আমের হলুদাভ উজ্জ্বলতায় রোদ যেন আরও দীপ্তিময় হয়ে ওঠে, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে রসাল এক প্রতীক্ষার ঘ্রাণ। আম বাঙালির কাছে শুধু একটি ফল নয়-এ এক আবেগ, এক স্বাদময় স্মৃতি; রোদে পাকা ছেলেবেলার এক অনুপম অনুধাবন। এই ফলের রাজা তার সরস মহিমায় গ্রীষ্মকে রূপান্তরিত করে মধুমাসে।
আমের উৎপত্তি ও ঐতিহ্য :
আমের আদি নিবাস ভারতীয় উপমহাদেশ ও মিয়ানমার অঞ্চল। প্রায় ৪ হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতা থেকেই আম চাষ হয়ে আসছে। সংস্কৃত ভাষায় একে বলা হতো ‘অম্র’, যার অর্থ ‘সুধা’। মুঘল আমলে আম ছিল এক রাজকীয় ভোজনবস্তু। সম্রাট আকবর বিহারের রাজমহলে ‘লাখ বাগ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে প্রায় এক লক্ষ আমগাছ রোপণ করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে আমের উৎপাদন অঞ্চল ও জাতভেদ :
বাংলাদেশের উর্বর মাটি ও উষ্ণ জলবায়ু আম চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। দেশের উত্তরাঞ্চল (রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর), মধ্যাঞ্চল (দিনাজপুর, পাবনা) এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে (সাতক্ষীরা, খুলনা) নানা জাতের সুস্বাদু আম উৎপাদিত হয়।
প্রধান জাতসমূহ :
প্রথম মৌসুম (মে-জুন): হাড়িভাঙ্গা, ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাত
মধ্য মৌসুম (জুন-জুলাই): হিমসাগর, আম্রপালি, গোপালভোগ (সীমিত)
শেষ মৌসুম (জুলাই-আগস্ট): ফজলি, আশ্বিনা, বারি মল্লিকা (বারি-১৪)
রাজশাহীর ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার-২০২৫ :
রাজশাহী জেলা প্রশাসন ২০২৫ সালের আম সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণের জন্য ‘ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার’ ঘোষণা করেছে। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বিভিন্ন জাতের আম নির্দিষ্ট তারিখ থেকে বাজারে আসবে, যা অপরিপক্ব আম সংগ্রহ ও কেমিক্যাল ব্যবহার রোধে সহায়ক হবে। সুস্বাদু ও নিরাপদ আম নিশ্চিত করতে নির্ধারিত
সময়সূচি হলো-
১৫ মে – গুটিআম
২০ মে – গোপালভোগ
২৫ মে – রানিপছন্দ ও লক্ষণভোগ
৩০ মে – হিমসাগর (ক্ষীরশাপাত)
১০ জুন – ল্যাংড়া ও ব্যানানা ম্যাংগো
১৫ জুন – আম্রপালি ও ফজলি
৫ জুলাই – বারি আম-৪
১০ জুলাই – আশ্বিনা
১৫ জুলাই – গৌড়মতি
কাটিমন ও বারি আম-১১ (আম্রপালি) জাতের আম সারা বছর পাকা সাপেক্ষে সংগ্রহযোগ্য।
আম চাষের বিস্তৃতি :
ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল ছাড়াও খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও বরিশালসহ অন্যান্য জেলায়ও উন্নত জাতের আম চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। বারি উদ্ভাবিত জাত (যেমন বারি-৪, বারি-১১) এবং কলম প্রযুক্তির সহায়তায় পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয়েছে।
পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা :
আমে রয়েছে-
ভিটামিন এ ও বিটা-ক্যারোটিন: চোখ ও ত্বকের জন্য উপকারী
ভিটামিন সি ও কে: রোগ প্রতিরোধ ও রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে
ফোলেট ও পটাশিয়াম: গর্ভবতী নারী ও হৃদযন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট: ক্যান্সার ও বার্ধক্য প্রতিরোধে সহায়ক
অর্থনীতি ও রপ্তানি :
বাংলাদেশে প্রায় ১.২ লক্ষ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়, যার বার্ষিক উৎপাদন ১২–১৫ লক্ষ মেট্রিক টন (২০২৩–২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী)। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সাতক্ষীরা থেকে আম রপ্তানি হয় মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যে। ২০২৩ সালে রপ্তানি আয় ছিল প্রায় ১৫০ কোটি টাকা (সূত্র: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট)।
আমের বহুমুখী ব্যবহার :
কাঁচা আম: আচার, চাটনি, আমসত্ত্ব
পাকা আম: জ্যাম, জুস, আইসক্রিম, ডেজার্ট
প্রক্রিয়াজাত পণ্য: আমের পাউডার, স্বাদযুক্ত পানীয়
সংস্কৃতি ও উৎসব :
রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও সাতক্ষীরায় আম উৎসবের আয়োজন করা হয়। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে আমগাছের প্রসঙ্গ বারবার এসেছে। ঝড়ের মধ্যে আম কুড়ানোর স্মৃতি, গ্রামীণ জীবনে গাছে চড়ে আম পাড়া বা টোকা মারার অভিজ্ঞতা আজও অনেকের কাছে স্মরণীয়।
ভেজাল আমের আশঙ্কা ও করণীয় :
ক্ষতির সম্ভাবনা –
পাকস্থলীতে এসিড বেড়ে পেটব্যথা ও বমি
স্নায়বিক সমস্যা ও ক্যান্সারের ঝুঁকি
শিশুদের বুদ্ধি বিকাশে বিঘ্ন
গর্ভবতী নারীর জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি
চেনার উপায় –
চেহারায় অস্বাভাবিক হলুদ বা চকচকে রঙ
প্রাকৃতিক ঘ্রাণের অভাব
বাইরের অংশ নরম অথচ ভিতরটা কাঁচা
পানিতে ভিজিয়ে রাখলে রাসায়নিক কিছুটা দূর করা যেতে পারে
ক্রেতার করণীয় :
স্থানীয় ও পরিচিত উৎস থেকে আম কেনা
রঙে বিভ্রান্ত না হয়ে ঘ্রাণ ও স্বাদ যাচাই
ঘরে এনে ভালোভাবে ধুয়ে খাওয়া
আমের ঘ্রাণে ঋতুরূপ পায় এক রসাল ব্যঞ্জনা, আর বাংলাদেশের মানুষ পায় এক অনন্য প্রাকৃতিক উপহার—স্বাদে, সুগন্ধে, ঐতিহ্যে অতুলনীয়। আজ এই ফল শুধু রসনার আনন্দ নয়, বরং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ুক বাংলাদেশের আমের সুনাম, আর প্রতিটি গ্রীষ্মে ফিরে আসুক সেই চিরচেনা মধুময় অভিজ্ঞতা-যা আমাদের শিকড়, স্বাদ ও স্মৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
Leave a Reply