এম. এম. রহমান, ফরিদপুর
বাংলাদেশের কৃষি এখন মুখোমুখি এক নীরব বিপদের-অপরিকল্পিতভাবে গৃহ নির্মাণের ফলে দিন দিন আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে। জনসংখ্যার চাপ ও গ্রামীণ বসতির অবাধ সম্প্রসারণের কারণে প্রতি বছর গড়ে ১ শতাংশ কৃষিজমি আবাসিক বা অনাবাদী জমিতে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ইইঝ) তথ্য মতে, এই হার অব্যাহত থাকলে আগামী ২০-৩০ বছরের মধ্যে দেশের খাদ্য উৎপাদন ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শহরাঞ্চলে গৃহনির্মাণে সুনির্দিষ্ট নকশা, পৌরসভার অনুমোদন ও বিধিনিষেধ মানতে হলেও গ্রামাঞ্চলে তেমন কোনো কার্যকর নীতিমালা বা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে মানুষ যার যার মতো করে আবাদি জমিতে ঘরবাড়ি তুলছে। অনেক ক্ষেত্রে একটি পরিবারের পৃথক সদস্যদের জন্য একাধিক ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে, যার ফলে একই জমি টুকরো টুকরো হয়ে কৃষির অযোগ্য হয়ে পড়ছে।
এছাড়া, অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর ও রাস্তা নির্মাণের ফলে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা। ড্রেনেজ ব্যবস্থা, খেলার মাঠ কিংবা সুষ্ঠু যোগাযোগব্যবস্থার কোনো পরিকল্পনা না থাকায় গ্রামগুলো হয়ে উঠছে অগোছালো ও বসবাস অনুপযোগী।
স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণহীনতার সুযোগে প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে কৃষিজমির পরিমাণ।
রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার কৃষক মো. রুহুল আমিন মোল্লা বলেন, “আগে যে জমিতে ধান ও পাট হতো, এখন সেখানে পাঁচটা বাড়ি উঠেছে। চাষ করতে পারি না, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি।”
বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বাপার্ড, গোপালগঞ্জ) এর যুগ্ম পরিচালক কৃষিবিদ মো. তোজাম্মেল হক বলেন, “আমরা যদি এখনই নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন না করি, তাহলে আগামী প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে চরম বিপদে পড়তে হবে। এটা শুধু একটি উন্নয়ন সমস্যা নয়, বরং ভবিষ্যতের অস্তিত্বের সংকট।”
ফরিদপুর সদর উপজেলার কৃষি অফিসার মো. আনোয়ার হুসাইন বলেন, “বিশেষ করে বাংলাদেশের উঁচু আবাদি জমিগুলো অপরিকল্পিত বাড়ি নির্মাণে ব্যবহার হচ্ছে। যে জমিগুলো সবজি চাষ ও ফলমুল উৎপাদনের উপযোগী। এগুলো এখনই সুরক্ষা গ্রহণের উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হুমকির মুখে পড়বে।”
প্রস্তাবিত সমাধান ও সুপারিশ :
গ্রামীণ গৃহায়নে বাস্তবসম্মত নীতিমালা :
কৃষিজমি রক্ষা ও আবাসনের ভারসাম্য বজায় রাখতে পরিকল্পিত গ্রামীণ গৃহায়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি।
দুই স্তরের অনুমোদন পদ্ধতি চালু :
গ্রামে কাঁচা বা সেমিপাকা বাড়ির জন্য ইউনিয়ন পরিষদ এবং পাকা বা বহুতল ভবনের জন্য উপজেলা পর্যায়ে নকশা অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা চালু করা উচিত।
‘কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন ২০২৩’-এর কঠোর প্রয়োগ :
এই আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষিজমি অননুমোদিত গৃহায়নের কবল থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
নিয়ম মেনে গৃহনির্মাণে আর্থিক প্রণোদনা :
সরকারি অনুমোদন ও নীতিমালা অনুসরণ করলে সংশ্লিষ্টদের সহজ শর্তে ঋণ, ভর্তুকি ও পুরস্কারের আওতায় আনা যেতে পারে।
বহুতল গৃহ নির্মাণে উৎসাহ প্রদান:
একতলা বহু ঘরের পরিবর্তে পরিকল্পিত বহুতল ঘর নির্মাণে উৎসাহ দিলে জমির ব্যবহার সাশ্রয়ী হবে এবং কৃষিজমি রক্ষা পাবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি :
ভূমির সঠিক ব্যবহার ও কৃষিজমি রক্ষায় সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে মিডিয়া, স্থানীয় প্রশাসন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে।
পরিকল্পনাহীন গৃহায়ন এখন আর শুধুই একটি উন্নয়ন সমস্যা নয়—এটি পরিণত হয়েছে একটি জাতীয় সংকটে। সরকার, প্রশাসন ও জনগণকে একযোগে এগিয়ে এসে এই সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে একদিন মানুষের মাথার উপর ছাদ থাকবে ঠিকই, কিন্তু পাতে দেওয়ার মতো ভাত থাকবে না। আজকের উদাসীনতা কালকে পরিণত হবে খাদ্যনিরাপত্তার অভাব ও সামাজিক অস্থিরতায়। তাই এখনই সময়, সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
Leave a Reply