মো. মাহ্বুবুর রহমান
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই অভিজ্ঞ ও সুপরিচিত উপদেষ্টা-অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ ও অধ্যাপক সি. আর. আবরার শিক্ষাখাতে গুণগত উন্নয়নের লক্ষ্যে যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তা শিক্ষক সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলে আশার সঞ্চার করেছে।
সাবেক শিক্ষা ও বর্তমান পরিকল্পনা উপদেষ্টা, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ দায়িত্বশীলতার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে স্বেচ্ছায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ওপর মনোনিবেশ করেন। তাঁর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শেষ কর্মদিবসে তিনি জানান, বেসরকারি শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন। এই ঘোষণা শিক্ষক সমাজে নতুন আশার সঞ্চার করে।
এই ধারাবাহিকতাকে এগিয়ে নিচ্ছেন বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি. আর. আবরার। গত ৪ জুন সচিবালয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি আসন্ন এইচএসসি ২০২৫ এবং সামগ্রিক শিক্ষা উন্নয়নের রূপরেখা তুলে ধরেন। শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ঢেলে সাজানো, উপাচার্য নিয়োগে স্বচ্ছতা, বদলি প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল রূপান্তর এবং শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার-সব মিলিয়ে শিক্ষা খাতে সময়োপযোগী ও গভীর সংস্কারের ইঙ্গিত দেন তিনি।
অধ্যাপক আবরার বলেন, “শিক্ষকদের এমন বেতন কাঠামো তৈরি করা হবে, যা মেধাবীদের এই পেশায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আগ্রহী করে তুলবে। শিক্ষকরা যেন সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারেন, সেদিকেও বিশেষ নজর দেওয়া হবে।”
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উপাচার্য নিয়োগে দীর্ঘদিনের অনিয়ম দূর করতে একটি বিশেষ বোর্ড গঠনের কথা জানান তিনি। প্রার্থীদের থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে আবেদন আহ্বান করা হবে এবং স্বচ্ছ যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেন।
আগামী জুলাই ২০২৫ থেকে কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকদের বদলি প্রক্রিয়া হবে পুরোপুরি অনলাইনভিত্তিক। এতে তদবির, প্রশাসনিক হয়রানি ও অনিয়ম কমে আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি শহর ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য দূর করার বিষয়ে বলেন, “আমরা চাই প্রযুক্তির এমন ব্যবহার নিশ্চিত করতে, যাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও ডিজিটাল ও আধুনিক শিক্ষার সুবিধা সমানভাবে পায়।”
এখানে উল্লেখ্য যে, সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এনটিআরসিএ-এর মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি শুরু হচ্ছে। তবে শিক্ষক সমাজের একান্ত চাওয়া হলো একটি সার্বজনীন বদলি ব্যবস্থা, যাতে তাঁরা একটি স্বচ্ছ, ন্যায়সঙ্গত এবং কার্যকর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বদলির সুযোগ পান। শিক্ষকদের মতে, এ ধরনের একটি সমন্বিত বদলি ব্যবস্থা হলে তা হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
এই দুই উপদেষ্টার স্বপ্ন ও পরিকল্পনা দেশের শিক্ষক সমাজে নতুন আশার আলো জাগিয়েছে। শিক্ষা খাতে দীর্ঘদিনের অসঙ্গতি দূর করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানসম্পন্ন ও স্বচ্ছ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তাঁরা যে অঙ্গীকার করেছেন, তা বাস্তবায়নের জন্য এখন প্রয়োজন নীতিনির্ধারক, প্রশাসন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সম্মিলিত সহযোগিতা।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য এবারের জাতীয় বাজেট থেকেই জিডিপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ রাখা শুরু করতে হবে। তাঁদের বিশ্বাস, শিক্ষা খাতে এ ধরনের বিনিয়োগই টেকসই ও আমূল পরিবর্তনের পথ সুগম করবে।
ইউনেস্কোর ঘোষণার আলোকে বলা যায়, জাতীয় বাজেটের জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা উচিত। অথচ ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এই হার মাত্র ১.৬৯%—যা অত্যন্ত কম এবং হতাশাজনক। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলছে, যেসব দেশ শিক্ষায় সাফল্য অর্জন করেছে, তারা জাতীয় বাজেটের গড়ে ৪% বা তার বেশি শিক্ষায় ব্যয় করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্যও এটি বিলাসিতা নয়, বরং টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি অপরিহার্য বিনিয়োগ।
শিক্ষক সমাজ এই ঘোষণাগুলোকে স্বাগত জানালেও বাস্তবায়ন নিয়ে কিছু সংশয় প্রকাশ করেছেন। অতীতে বিভিন্ন সময়ে গৃহীত শিক্ষা-সংস্কারের উদ্যোগগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও গড়িমসির কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রকৃতভাবে উপকৃত হতে পারেননি।
শিক্ষা উপদেষ্টার বক্তব্যের পর শিক্ষা সচিবের পক্ষ থেকে আরও একটি ঘোষণা আসে—বেসরকারি শিক্ষকদের সার্বজনীন পেনশনের আওতায় আনার পরিকল্পনা করছে সরকার। তবে শিক্ষক সমাজ এই প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের মতে, তাঁদের মতামত উপেক্ষা করে যদি এই ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
অতীতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও এ ধরনের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল শিক্ষকদের বিরোধিতার কারণে—যার পাশে অধ্যাপক আবরারও দাঁড়িয়েছিলেন। ফলে এখন একই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে তা এক ধরনের নীতিগত দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করবে—যা তাঁর পক্ষ থেকে অপ্রত্যাশিত।
তাই ভবিষ্যৎ শিক্ষানীতিতে যেকোনো বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সংশ্লিষ্টদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে, আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করাই হবে সময়োপযোগী।
শিক্ষকরা যেমন উপদেষ্টাদের কথায় আশাবাদী, তেমনি বাস্তবায়নের দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। কারণ, শুধু ঘোষণা নয়—কার্যকর বাস্তবায়নই শিক্ষাখাতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
সততা ও স্থায়িত্বের সঙ্গে এগিয়ে এলে বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবে শিক্ষার এক নতুন ইতিহাস—যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে শিক্ষকের মর্যাদা, শিক্ষার্থীর উন্নয়ন এবং জাতির সামগ্রিক অগ্রগতি।
✍️ মো. মাহবুবুর রহমান
সহ. অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ
ফরিদপুর সিটি কলেজ
ও
সম্পাদক, অধ্যাপক আব্দুর রব স্মারকগ্রন্থ
Leave a Reply