মো. মাহবুবুর রহমান
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ৯৩৫ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৯৫ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা, যেখানে আগের বছর তা ছিল ৯৪ হাজার ৭১০ কোটি। সংখ্যাগতভাবে এই বৃদ্ধিকে অনেকেই ইতিবাচক ভাবলেও, বিশ্লেষকদের মতে এটি এক ধরনের ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ – দেখনদারি বাড়লেও বাস্তব উন্নয়ন অনুপস্থিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন এই বিষয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন, “এইভাবে বরাদ্দ বাড়ানোর গল্প আগের আওয়ামী লীগ সরকারও করেছিল। অংকে কিছু টাকা বাড়া যে আসলে বাড়া না, সেটা বোঝার মানুষ এই দেশে কম বলে সরকারেরা আমাদেরকে এই টোটকা খাওয়াতে পারেন।”
“টাকার অংকে বরাদ্দ বেড়েছে – এইটা চরম ফাঁকিবাজি কথা। বলতে হবে জিডিপির স্কেলে শিক্ষায় বরাদ্দ কতটা বেড়েছে।”
২০১৮ সালে শিক্ষা খাতে জিডিপির ২.২৮% বরাদ্দ থাকলেও তা ক্রমান্বয়ে কমে এসে গত অর্থবছরে ঠেকেছে মাত্র ১.৬৯%-এ। এবারও তার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। অথচ শিক্ষা খাতে বাস্তব অগ্রগতি নির্ভর করে এই অনুপাতেই, শুধুমাত্র টাকার অঙ্কে নয়।
ইউনেস্কোর মতে, একটি দেশের উচিত জিডিপির সর্বনিম্ন ৫-৬% শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া। এই লক্ষ্যের পেছনে আছে-শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করা, ছাত্রদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করা।
ভিয়েতনাম আজ থেকে ১২ বছর আগে সম্পদে পিছিয়ে ছিল। অথচ তারা গত এক দশক ধরে জিডিপির ৪% বা তার বেশি শিক্ষায় ব্যয় করছে। এর ফলেই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ের ৬০০-এর মধ্যে রয়েছে। ফলে অ্যাপেল, ইন্টেল-এর মতো প্রযুক্তি জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশে কেউ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে না, যদি তারা আমাদের এয়ারপোর্ট, আমলাতন্ত্র, চট্টগ্রাম পোর্ট বা যানজটের বাস্তবতা দেখে। এই এআইয়ের যুগে এখনো স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল চালু করতে না পারার বাস্তবতা আমাদের উন্নয়ন চিন্তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কিছুটা বাড়ানো হলেও তা যে কতটা অর্থবহ, সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। শুধু সংখ্যার প্রদর্শনী নয়, বাস্তবিক মানোন্নয়ন ও দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষানীতির বাস্তবায়নই এখন সময়ের দাবি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বরাদ্দের বড় অংশই পরিচালন ব্যয়ে ব্যয় হয়, উন্নয়ন ব্যয়ে নয়, যা শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে বড় বাধা সৃষ্টি করে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (CPD)-এর ‘Education Budget 2025’ শীর্ষক একটি পলিসি ব্রিফ অনুযায়ী, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে উন্নয়ন বরাদ্দের হার এখনো প্রয়োজনীয় মাত্রায় পৌঁছায়নি। এর ফলে গবেষণা, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও পাঠ্যসূচির আধুনিকীকরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, শুধু বরাদ্দ বাড়ানো নয়, বরাদ্দের কার্যকর ব্যবহার, দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন এবং গবেষণাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলাই এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের প্রত্যাশা ছিল-বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার, যেখানে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে এবং দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদগণ গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী ভূমিকায় রয়েছেন, তারা গতানুগতিকতা ভেঙে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জিডিপির উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দিবেন।
পৃথিবীর বহু উন্নয়নশীল দেশের অভিজ্ঞতা বলে, শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ ছাড়া টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়।
তাই জাতীয় বাজেটের চূড়ান্ত সংস্করণে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানো এখন সময়ের অত্যাবশ্যক দাবি হয়ে উঠেছে।
Leave a Reply