মো. মাহবুবু রহমান
বর্তমানে এনটিআরসিএ-এর মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য সীমিত পরিসরে বদলি প্রথা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নীতিনির্ধারকদের মতে, এনটিআরসিএ-এর মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ি থেকে বহু দূরে কর্মস্থলে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন, তাই একটি কার্যকর বদলি প্রক্রিয়া প্রয়োজন।
তবে বাস্তবতা আরও বিস্তৃত। শুধু এনটিআরসিএ-নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরাই নন, তার আগেও বহু শিক্ষক চাকরির প্রয়োজনে নিজ জেলা বা বাড়ি থেকে বহু দূরে নিয়োগ পেয়ে দীর্ঘদিন ধরে দূরের জেলায় বাসা ভাড়া করে অবস্থান করছেন। ফলে বদলি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটি শ্রেণি নয়, সমগ্র বেসরকারি শিক্ষক সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি সার্বিক, বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি।
দীর্ঘদিন একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকার ফলে অনেক শিক্ষক অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, গ্রুপিং বা অন্যান্য কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন, যা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় জটিলতা সৃষ্টি করছে। অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান কার্যত অসহায় বোধ করেন, যা শিক্ষার পরিবেশ ও মান ব্যাহত করে।
বদলি প্রথার সুফল:
* পেশাগত মানোন্নয়ন: নতুন পরিবেশে কাজের সুযোগ শিক্ষকদের দক্ষতা বিকাশে সহায়ক হবে।
* প্রতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা: দীর্ঘদিন একই প্রতিষ্ঠানে থাকায় সৃষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তির জটিলতা হ্রাস পাবে।
* সুস্থ প্রতিযোগিতা: বদলির সম্ভাবনা থাকলে শিক্ষকরা আরও পেশাদার মনোভাব নিয়ে দায়িত্ব পালন করবেন।
•
প্রস্তাবিত সংস্কারসমূহ:
১. সার্বিক বদলি ব্যবস্থা চালু:
শুধু এনটিআরসিএ-নিয়োগপ্রাপ্তদের জন্য নয়, সমস্ত বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য বদলি প্রথা চালু করা উচিত। মেধা, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পরিচালিত বদলি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ উন্নয়নে সহায়ক হবে। একইসঙ্গে পূর্বে নিয়োগপ্রাপ্ত সেইসব শিক্ষকদের কথাও বিবেচনায় আনতে হবে, যাঁরা বছরের পর বছর পরিবার থেকে দূরে অবস্থান করছেন।
২. ন্যায্য পদোন্নতির ব্যবস্থা:
বর্তমানে কলেজ পর্যায়ে বিভাগভিত্তিক অনুপাত পদ্ধতি অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক। কেউ ৮–১০ বছরে পদোন্নতি পেলেও কেউ ২০–২৫ বছরেও বঞ্চিত হচ্ছেন। এই অনুপাত প্রথা বাতিল করে একাডেমিক যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে স্বচ্ছ ও ন্যায্য পদোন্নতির ব্যবস্থা করা উচিত।
৩. জাতীয়করণ ও সরকারি সুবিধা সম্প্রসারণ:
জাতীয়করণ এখন সময়ের দাবি। দ্রুত ঘোষণার মাধ্যমে জাতীয়করণ প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে। পাশাপাশি, গৃহভাড়া, চিকিৎসা, প্রণোদনা ভাতা ইত্যাদি সরকারি চাকরিজীবীদের মতো বেসরকারি শিক্ষকদেরও প্রদান করা উচিত।
৪. সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ সৃষ্টি:
বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক পদেই আটকে আছেন। সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ সৃষ্টির মাধ্যমে পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে, যা মেধাবী শিক্ষক ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষা পেশায় আকৃষ্ট করবে।
৫. প্রশাসনিক নিয়োগে স্বচ্ছতা:
* অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে এনটিআরসিএ পরিচালিত হওয়া উচিত।
* অফিস সহকারী ও অন্যান্য নন-টিচিং স্টাফ নিয়োগ কেন্দ্রীয়ভাবে /জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে স্থানীয়ভাবে পরিচালনা করলে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম হ্রাস পাবে।
•
৬. ACR চালু ও মূল্যায়ন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন:
* বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন (ACR) চালুর মাধ্যমে শিক্ষক মূল্যায়ন কার্যকর হবে।
* এই মূল্যায়নে ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী ও পরিচালনা পর্ষদের মতামত অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
* মূল্যায়নের ভিত্তিতে পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরও বাস্তবসম্মত হবে।
•
৭. প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা:
* নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে শিক্ষকরা পাঠদানের আধুনিক কৌশল, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও ডিজিটাল শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারেন।
* প্রশিক্ষণ শেষে আর্থিক প্রণোদনা বা অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট প্রদান করলে শিক্ষকরা প্রশিক্ষণে আরও আগ্রহী হবেন এবং শিখিত দক্ষতা বাস্তবে প্রয়োগ করবেন।
•
বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি, পদোন্নতি, জাতীয়করণ, প্রশিক্ষণ, প্রশাসনিক নিয়োগ ও আর্থিক নিরাপত্তা—এই ছয়টি বিষয়ে একটি সমন্বিত, স্বচ্ছ ও বাস্তবভিত্তিক নীতিমালা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এই কাঙ্ক্ষিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষক সমাজকে আরও পেশাদার, গতিশীল এবং শিক্ষাকেন্দ্রিক করে তোলা সম্ভব।
এর সুফল পৌঁছাবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে। একইসাথে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন ঘটবে, যা ভবিষ্যতে একটি উন্নত, মানবিক ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
Leave a Reply