মঙ্গলবার, ০৫ অগাস্ট ২০২৫, ০৩:৩৯ অপরাহ্ন

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের এক স্টেশনেই ব্যয় কমছে সাড়ে ১৪ কোটি টাকা

  • Update Time : মঙ্গলবার, ৮ এপ্রিল, ২০২৫, ১০.০৩ এএম
  • ২০৭ জন সংবাদটি পড়েছেন
নিজস্ব প্রতিবেদক, ভাঙ্গা

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন এক স্টেশনেই ব্যয় কমছে প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকা। এ জন্য স্টেশন ভবনের রং, টাইলস, কমোডসহ কিছু পণ্যের ধরন পরিবর্তন করা হবে। আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা (এসি) বাদ দিয়ে লাগানো হবে বৈদ্যুতিক পাখা। ঠিকাদারের সঙ্গে দর-কষাকষি করেও কিছু ব্যয় কমানো হয়েছে।

এই ব্যয় কমছে ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশন স্টেশন নির্মাণে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, ঢাকা-যশোর রেলপথের এই স্টেশন নির্মাণে শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৫৩ কোটি টাকা। এরই মধ্যে ৯০ শতাংশের মতো কাজও শেষ হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে ব্যয় কমানোর জন্য প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে চাপ দেওয়ায় শেষ মুহূর্তে সাড়ে ১৪ কোটি টাকা ব্যয় কমানোর প্রাক্কলন করা হয়েছে।

প্রকল্পের একটি নথি অনুযায়ী, নকশা ও জরিপ ফি, সংকেত ও টেলিযোগাযোগব্যবস্থা স্থাপন, পরিবেশগত সুরক্ষা, রেলক্রসিং গেট নির্মাণ, নদীশাসন ও পাথরবিহীন রেলপথ নির্মাণে প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। এ ছাড়া পণ্যের মূল্য সমন্বয় থেকে এবং কাজ বাড়তে পারে, এমন বিবেচনায় রাখা টাকাও সাশ্রয় হয়েছে।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর বিগত সরকারের আমলে নেওয়া প্রকল্পের ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছেন। নতুন প্রকল্প ও কেনাকাটায় সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী, ইতিমধ্যে কিছু কিছু সাশ্রয় হয়েছে, হচ্ছে।

ভাঙা জংশন স্টেশনটির অবস্থান লোকালয় থেকে অনেকটাই দূরে। এরপরও স্থানীয় রাজনীতিকদের চাপে জাঁকজমকপূর্ণ স্টেশন ভবন তৈরির সিদ্ধান্ত হয়।

গত বছরের ১২ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় ‘বিপুল ব্যয়ে স্টেশনবিলাস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বিপুল ব্যয়ে স্টেশন ভবন নির্মাণের বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। এরপর ভাঙা জংশন স্টেশনে ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেয় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। বিপুল ব্যয়ে নির্মাণ করা কক্সবাজার রেলস্টেশনের অব্যবহৃত অংশ ভাড়া দিয়ে আয় বৃদ্ধির নির্দেশ দেন উপদেষ্টা। এ ছাড়া তিনি অন্যান্য বড় স্টেশনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করারও নির্দেশনা দেন।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, ভাঙার নতুন স্টেশনটির পাঁচ কিলোমিটার পরে ভাঙা জংশন এবং ১২ কিলোমিটার আগে মাদারীপুরের শিবচর স্টেশন। পুরোনো জংশনটি প্রকল্পের আওতায় মেরামত ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। দুটি (ভাঙা জংশন ও শিবচর) স্টেশনের মাঝখানে এমন কোনো শহর বা উল্লেখ করার মতো কোনো স্থাপনা নেই। অনেকটা মাঠের মাঝখানে বিপুল টাকায় ভাঙা স্টেশনটি নির্মাণ করা হয়েছে। স্টেশন ভবনটি তিনতলা।

তবে শুরুতে এখানে বিপুল ব্যয়ে স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল না। রেলওয়ে সূত্র জানায়, সংসদের তৎকালীন চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী ওরফে লিটন চৌধুরী এবং তাঁর ভাই ভাঙার সাবেক সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরীর চাপে স্টেশন নির্মাণের বিষয়টি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাঁরা গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে।

রেলের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাদারীপুরে অলিম্পিক ভিলেজ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হবে—এই কথা বলে লিটন চৌধুরী ও নিক্সন চৌধুরী স্টেশনটি করার জন্য চাপ দেন।

গত ৫ আগস্টের পর থেকে লিটন ও নিক্সন আত্মগোপনে থাকায় এ ব্যাপারে তাঁদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

সক্ষমতার তুলনায় ট্রেন চলছে কম

পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও নড়াইল জেলা নতুন করে রেলযোগাযোগের আওতায় এসেছে। ২০২৩ সালে রেলপথটির একাংশ চালু করা হয়। পুরোদমে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ট্রেন চালু হয়েছে গত ডিসেম্বর মাসে। এখন ঢাকা থেকে খুলনায় সাড়ে চার ঘণ্টায় ট্রেনে যাওয়া যায়। আগে যমুনা সেতু হয়ে যেতে লাগত ৮-৯ ঘণ্টা। তবে বিপুল টাকায় নির্মিত এই রেলপথ দিয়ে সক্ষমতার তুলনায় কম ট্রেন চলাচল করছে।

প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ আছে, নতুন এই রেলপথ দিয়ে প্রতিদিন ২৪ জোড়া বা ৪৮টি যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করতে পারবে। তবে এখন সাকল্যে চলছে ১০টি যাত্রীবাহী ট্রেন। মালবাহী কোনো ট্রেন চলছে না।

রেলেওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এই রেলপথে ট্রেন চলাচল ও আয় প্রক্ষেপণ করার পেছনে কতগুলো বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। যেমন, মোংলা বন্দর থেকে রেলে মালামাল পরিবহন, বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় পণ্যের ট্রানজিট, ফরিদপুর থেকে পটুয়াখালী পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণের মাধ্যমে পায়রা সমুদ্রবন্দরকে যুক্ত করা। তবে অদূর ভবিষ্যতে এর কোনোটাই হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ ছাড়া জনবলের অভাব, ইঞ্জিনের সংকটসহ নানা কারণে যাত্রীবাহী ট্রেনও বাড়ানো যাচ্ছে না।

পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে চীন ও বাংলাদেশ মধ্যে জিটুজি (সরকারের সঙ্গে সরকার) পদ্ধতিতে। এ প্রকল্পের ঠিকাদার চীন সরকারেরই ঠিক করে দেওয়া চায়না রেলওয়ে গ্রুপ। প্রকল্পে চীন অর্থায়ন করে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা। বাকিটা বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব খাত থেকে ব্যয় করা হয়। তবে ব্যয় কমার ফলে চীনা ঋণ থেকে ৬০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ফেরত দেওয়া হয়েছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান বলেন, স্টেশন ভবন নির্মাণে ব্যয় কমানোর চেষ্টা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এটা একটি প্রকল্পের ঘটনা হলেও অন্যান্য প্রকল্পেও কীভাবে ব্যয় কমানো যায়, সেই চেষ্টা চালাতে হবে। তিনি বলেন, মেগা প্রকল্প মানেই বিপুল খরচ। প্রকল্প নেওয়ার আগেই ভাবতে হবে যে বিনিয়োগ উঠে আসবে কি না। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নের পর তা থেকে কী সুবিধা পাওয়া গেল, তা প্রকল্প নেওয়ার সময় করা প্রক্ষেপণ অর্জন করেছে কি না, তা–ও মূল্যায়নও করতে হবে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

jmitsolution_16012
© All rights reserved © 2025
Developed By : JM IT SOLUTION