স্মরণ :
বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক অধ্যাপক আবদুর রব ১৯৫০ সালের ১০ মার্চ রাজবাড়ী জেলার তৎকালীন পাংশা (বর্তমান কালুখালী) থানার চরভিটি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী ও আদর্শবান।
তাঁর শিক্ষাজীবনের প্রমাণ মিলে-১৯৬৬ সালে পাংশা থানার মৃগী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে নবম স্থান অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে প্রথম বিভাগে আইএ পাস করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ মাস্টার্স ডিগ্রি কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি দুই ফুফাতো ভাই-দিয়ানত ও আব্দুল বারেককে নিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। তিনি ভারতের দেরাদুনে মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য মনোনীত হন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে বয়সে সর্বকনিষ্ঠ হলেও মেধার কারণে তিনি লিডারশিপের গৌরব অর্জন করেন। উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে লিডার হিসেবে মনোনীত হওয়া সত্ত্বেও, তিনি নিজের মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে আব্দুল মতিনকে লিডার এবং নিজেকে ডেপুটি লিডার করার প্রস্তাব দেন।
দেশে ফিরে পরিকল্পিতভাবে এলাকা ভাগ করে বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার যুবকদের সংগঠিত করে তিনি গড়ে তোলেন এক বিশাল মুক্তিযোদ্ধাবাহিনী- যা ‘রব বাহিনী’ নামে পরিচিত। এই বাহিনী রাজবাড়ীকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করার যুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রাখে।
তাঁর দক্ষ নেতৃত্বে প্রশিক্ষিত এই বাহিনী কালুখালী রেলস্টেশনের সম্মুখযুদ্ধে গোয়ালন্দ মহকুমার রাজাকার বাহিনীকে পরাস্ত করে এবং রাজাকার কমান্ডার নাজিউর রহমান নীলু চৌধুরীসহ অন্যান্যকে বন্দি করে। নীলু চৌধুরীকে মৃগী ক্যাম্পে নিয়ে আসে। নীলু চৌধুরীর বাহিনীর কাছ থেকে প্রায় একশটি ‘থ্রি-নট-থ্রি’ রাইফেল উদ্ধার করা হয়, যা রব বাহিনীকে রাজাকার ও বিহারিদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অসাধারণ শক্তি প্রদান করে।
পাকিস্তানি সরকার কর্তৃক মনোনীত রাজবাড়ীর তৎকালীন গভর্নর ও বিহারিদের নেতা সৈয়দ খামারও রব বাহিনীর কাছে সম্মুখযুদ্ধে পরাস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন।
তাঁর বাসা থেকে উদ্ধারকৃত বিপুল স্বর্ণালংকার ও নগদ অর্থ অধ্যাপক আবদুর রব রাজবাড়ীর এসডিও শাহ মোহাম্মদ ফরিদের নিকট জমা দেন। পরবর্তীতে সৈয়দ খামারের স্ত্রী ছায়া দিদিমণি সেই জমা স্লিপ অধ্যাপক রবের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন এবং নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার অক্ষত অবস্থায় সরকারি কোষাগার থেকে ফেরত পান। এজন্য ছায়া দিদিমণি বিভিন্ন জনের কাছে কমান্ডার আবদুর রবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাতেও রব বাহিনী স্মরণীয় ভূমিকা রাখে। এটি অত্র এলাকায় সর্বজনবিদিত।
অধ্যাপক আবদুর রবের কর্মজীবন শুরু হয় কালিয়াকৈর ও ঘোড়াশাল কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে। পরবর্তীতে তিনি ফরিদপুর ইয়াছিন কলেজে যোগ দেন এবং ১৯৮৭ সালে কলেজটি সরকারিকরণে বিশেষ অবদান রাখেন। এরপর বরিশাল মহিলা কলেজ, সদরপুর কলেজ ও গৌরনদী কলেজে দায়িত্ব পালন শেষে পুনরায় ইয়াছিন কলেজে উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন এবং ২০০৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন শিক্ষা বিস্তারের এক অক্লান্ত সাধক।
নিজ জন্মভূমি এলাকায় তাঁর ফুফাতো ভাই ও সহযোদ্ধা শহীদ দিয়ানত আলীর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য বহু বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘মৃগী শহীদ দিয়ানত কলেজ’। কলেজ প্রতিষ্ঠায় এলাকার সাধারণ লোকজন সক্রিয়ভাবে তাঁর পাশে ছিলেন। এছাড়াও ফরিদপুর মহাবিদ্যালয় ও ফরিদপুর সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা।
শিক্ষক সমাজের অধিকার আদায়েও নেতৃত্ব দিয়েছেন। শিক্ষা আন্দোলনের পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডেও সক্রিয় ছিলেন। ফরিদপুর রোটারি ক্লাবের সেক্রেটারি ও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি বাংলাদেশ রোটারি ডিস্ট্রিক্টের ডেপুটি গভর্নর হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। নিজ প্রতিষ্ঠিত মৃগী শহীদ দিয়ানত কলেজ প্রাঙ্গণে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
আজ তাঁর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এক মহান মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক অধ্যাপক আবদুর রবকে। তাঁর কর্মময় জীবন আগামী প্রজন্মকে দেশপ্রেম, ন্যায়নিষ্ঠা ও মানবসেবায় অনুপ্রাণিত করুক-এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে প্রার্থনা করি-এই কর্মবীরকে যেন তিনি জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করেন। আমিন।
Leave a Reply