মো. মাহবুবুর রহমান, ফরিদপুর
“যারা মানবেতর জীবন যাপন করেন, তাদের কাছ থেকে উন্নত দেশের মতো মানসম্মত শিক্ষা চাওয়াটাই উপহাস।”- এভাবেই শিক্ষাব্যবস্থার অসংগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ।
বৃহস্পতিবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রশিক্ষণ দপ্তর আয়োজিত ‘raining for Teachers on Research Methodology’ শীর্ষক তিন দিনব্যাপী অনলাইন প্রশিক্ষণের সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। অংশ নেন দেশের বিভিন্ন কলেজের ৪০ জন শিক্ষক।
অবহেলার নির্মম চিত্র :
ড. আমানুল্লাহ বলেন, প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকরা রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা ও আর্থিক বঞ্চনায় জীবনযুদ্ধে হিমশিম খাচ্ছেন। বিশেষ করে বেসরকারি কলেজে ভিসি নিয়োগপ্রাপ্ত (part-time) শিক্ষকরা মাসে মাত্র ৫,০০০-৮,০০০ টাকা সম্মানী পান, যা দিয়ে সম্মানজনক জীবন সম্ভব নয়।
“এই বাস্তবতায় তাঁদের কাছে গবেষণা ও মানসম্মত পাঠদান প্রত্যাশা করা অমানবিক,”- জানান তিনি।
শিক্ষার মান নির্ভর করে শিক্ষকের মর্যাদার উপর :
উপাচার্য বলেন, “কলেজ শিক্ষার মান উন্নয়ন না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়ন অসম্ভব।” অথচ কলেজের শিক্ষকরা পাচ্ছেন না স্থায়ী পদ, বেতন, কিংবা প্রশিক্ষণের সুব্যবস্থা।
উন্নত দেশের সঙ্গে বৈষম্য :
উন্নত বিশ্বে কলেজ শিক্ষকরা পান স্থায়ী পদ, উচ্চ বেতন, পেনশন, গবেষণা অনুদান ও প্রশিক্ষণ সুবিধা। যুক্তরাজ্যে কলেজ শিক্ষকের বার্ষিক আয় প্রায় ৫০,০০০ পাউন্ড। ফিনল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় শিক্ষকতা একটি সম্মানজনক পেশা। অথচ বাংলাদেশে তা রয়ে গেছে অবহেলার ছায়ায়।
শিক্ষকদের অভিজ্ঞতায় প্রতিচ্ছবি :
ফরিদপুরের এক শিক্ষক বলেন, “১৫ বছর ধরে ক্লাস নিচ্ছি। মাসে ৮,০০০ টাকা পাই, কোনো নিশ্চয়তা নেই। অথচ ক্লাস, খাতা দেখা, পাঠ পরিকল্পনা-সবই করি।”
সিরাজগঞ্জের এক বাংলা শিক্ষক বলেন, “সাহিত্য পড়াই, অথচ সংসারে সাহিত্য তো দূরের কথা, চাল-ডাল জোগাড় করাও কষ্টকর।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত :
শিক্ষাবিদদের মতে, মানোন্নয়ন কেবল পাঠ্যক্রম দিয়ে নয়, বরং শিক্ষকের জীবনমান উন্নয়ন ছাড়া কোনো পরিবর্তন টেকসই হবে না। ইয়াসিন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আলতাফ হোসেন বলেন, “শিক্ষককে টিউশনের জন্য ছুটতে হলে তা তাঁর মর্যাদা ও শিক্ষাব্যবস্থার জন্য লজ্জাজনক।”
সমাধানে জরুরি নীতিগত সিদ্ধান্ত –
শিক্ষাবিদদের প্রস্তাবনায় এসেছে:
(১) ভিসি নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য সরকারি বেতন কাঠামো
(২) মাসিক বেতন, ইনক্রিমেন্ট ও
চাকরির নিশ্চয়তা
(৩) গবেষণাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও পেশাগত উন্নয়ন
(৪) স্বচ্ছ পদোন্নতি ব্যবস্থা
(৫) বেসরকারি কলেজে নিয়মিত পরিদর্শন ও অডিট
উপাচার্যের বক্তব্য কোনো ব্যক্তিগত অনুভব নয়, বরং তা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নিচতলার এক কঠিন বাস্তবতা। শিক্ষকেরা যদি অবহেলায় ডুবে থাকেন, তবে শিক্ষার আলো সমাজে কতদূর পৌঁছাবে-এই প্রশ্ন আজ রাষ্ট্র ও সমাজের দরজায় কড়া নাড়ছে।
Leave a Reply