মো. মাহবুবুর রহমান
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম সম্ভাবনাময়, ঐতিহ্যবাহী ও জনবহুল জেলা ফরিদপুর। ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক গুরুত্বে সমৃদ্ধ হলেও আজও এই জেলার মানুষ একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মৌলিক উচ্চশিক্ষা সুবিধা থেকে বঞ্চিত এটি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। এই বঞ্চনা আজ আর কেবল আঞ্চলিক চাহিদা নয়-এটি রূপ নিয়েছে একটি বাস্তব ও সময়োপযোগী জাতীয় প্রয়োজনে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের ধারাকে আরও গতিশীল করতে হলে ফরিদপুরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এখন অত্যন্ত জরুরি ও যৌক্তিক।
১৮১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ফরিদপুর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাচীনতম প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলোর একটি। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ১১২ কিলোমিটার দূরে এবং পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সরাসরি সংযুক্ত হওয়ায় ফরিদপুর এখন কৌশলগতভাবে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা হিসেবে বিবেচিত। রাজবাড়ী, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাগুরা ও নড়াইলের মধ্যবিন্দুতে অবস্থিত এই জেলাটি স্বাভাবিকভাবেই একটি আঞ্চলিক উচ্চশিক্ষা-হাবে পরিণত হওয়ার যথার্থ দাবিদার।
বর্তমানে ফরিদপুরে রয়েছে ১৩টি সরকারি ও ২৪টি বেসরকারি কলেজ, একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, কৃষি কলেজ ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। রাজেন্দ্র কলেজে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৮ হাজারের বেশি। এত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকার পরও এখানে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুপস্থিতি ফরিদপুরবাসীর প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয় হওয়া উচিত। এই ঘাটতির ফলে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এখানকার মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারছে না-এটি জাতীয় উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ থেকেও গভীরভাবে চিন্তার বিষয়।
২০২২ সালের জনসংখ্যা অনুসারে, ফরিদপুরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ২১ লাখেরও বেশি, আর বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে (ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মাগুরা, নড়াইল) এই সংখ্যা ৮০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এত বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন একটি ন্যায্য ও যথাযথ দাবি। অনেক শিক্ষার্থী আর্থিক কারণে ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পায় না। ফরিদপুরে মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তারা স্বপ্ন দেখার নতুন সুযোগ পাবে- দেশ গঠনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে ইয়াছিন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আলতাফ হোসেন বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাবে বহু মেধাবী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ছে।”
সমাজ সেবায় জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সমাজসেবক ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর এম এ সামাদ এর মতে, “পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন হয়েছে, এখন বিভাগ বাস্তবায়ন ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা জরুরি।”
রাজেন্দ্র কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী তানিয়া আহমেদ বলেন, “ঢাকায় পড়তে গেলে খরচ অনেক বেশি। ফরিদপুরেই বিশ্ববিদ্যালয় হলে আমরা স্বস্তিতে পড়াশোনা করতে পারতাম।”
শুধু শিক্ষার দিক থেকেই নয়-অর্থনৈতিক দিক থেকেও ফরিদপুর একটি সম্ভাবনাময় জেলা। কৃষিনির্ভর এই জনপদে শিল্প ও প্রযুক্তি খাতে অগ্রগতির জন্য গবেষণা ও উদ্ভাবনের সুযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হলে এখানকার কর্মসংস্থান, গবেষণা, প্রযুক্তি ও উদ্যোক্তা উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হবে। শহরের বাইপাস সড়কের পাশে যে বিস্তীর্ণ ফাঁকা জমি রয়েছে, তা একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য আদর্শ।
প্রশ্ন উঠতেই পারে-কুমিল্লা, বরিশাল, ময়মনসিংহে যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, তখন ফরিদপুর কেন এখনও অপেক্ষায়? অবকাঠামো, জনসংখ্যা, ইতিহাস, ভৌগোলিক গুরুত্ব-সবদিক থেকেই ফরিদপুর একটি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপযুক্ত স্থান। তারপরও এই প্রান্তিকতা কেন-এই প্রশ্ন আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং বর্তমান সরকারের দায়িত্বশীল মহলের প্রতি আমাদের আন্তরিক ও বিনীত অনুরোধ-আর যেন বিলম্ব না হয়।
এই জনপদের মানুষের বহু প্রতীক্ষিত ন্যায্য দাবি বাস্তবায়নের জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হোক। ফরিদপুরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে উচ্চশিক্ষা ও উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করুন।
এই দাবিটি শুধু ফরিদপুরের নয়-এটি একটি অঞ্চলের, একটি সময়ের, একটি ভবিষ্যতের। এই বিশ্ববিদ্যালয় একদিন হয়ে উঠবে দক্ষিণ-পশ্চিমের স্বপ্নের বাতিঘর-আলোকিত করবে একটি প্রজন্মকে।
Leave a Reply