রবিবার, ০৩ অগাস্ট ২০২৫, ০১:৩৯ পূর্বাহ্ন

পুলিশের গাড়িতে বসেও কুপিয়ে মারার হুমকি দেয় সন্ত্রাসীরা

  • Update Time : বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ১.২১ পিএম
  • ১৪৯ জন সংবাদটি পড়েছেন

নিজস্ব প্রতিবেদন

কিশোর গ্যাংয়ের উপদ্রবে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় প্রকাশ্যে এক দম্পতিকে কোপানোর দৃশ্য ভাইরাল হয়েছে। হামলার সময় এলাকাবাসী দুইজনকে ধরে পিটুনি দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। এ সময় পুলিশের গাড়িতে বসেও এলাকাবাসীকে কুপিয়ে হত্যার হুমকি দেয় সন্ত্রাসীরা।

আটকের পর হুমকি দেওয়া দুইজন হলেন মো. মোবারক হোসেন (২৫) ও রবি রায় (২২)। এছাড়া কোপানোর ঘটনায় সরাসরি জড়িত আলফাজ (২৩) নামের একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

এলাকাবাসীর তথ্য মতে, হামলাকারী এই কিশোর গ্যাং বা ছিনতাইকারী গ্রুপে ২০ থেকে ২২ জন সদস্য রয়েছে। তারা নিয়মিত উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে ২৮ নম্বর সড়কে গড়ে ওঠা দোকানগুলোতে আড্ডা দেয়। গ্যাংয়ের পুরো সদস্যকে গ্রেফতার করতে না পারলে এ রকম হামলার ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

কী ঘটেছিল সেদিন?

উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের ৭, ৮, ৯ ও ২৮ নম্বর সড়ক ঘুরে এবং এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের উত্তর পাশে ২৮ নম্বর সড়কের ওপর একাধিক খাবারের দোকান গড়ে উঠেছে। সন্ধ্যা হলেই এসব দোকান ও দোকান ঘিরে আশপাশের রাস্তায় আড্ডা বসায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা।

সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) রাতে উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরে মার্কেট থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন মেহেবুল হাসান (৩৭) ও তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার ইপ্তি (২৮)। রাত সাড়ে ৯টার দিকে স্কুলের পূর্বপাশে ৯ নম্বর রোডে ‘বেপরোয়া’ একটি মোটরসাইকেল একটি রিকশাকে ধাক্কা দেয়। সেখানে মেহেবুল ও নাসরিন এর প্রতিবাদ করেন। ওই রিকশার আরোহীরা উচ্চবাচ্চ করে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেও বিপত্তি বাধে মেহেবুল ও নাসরিনের সঙ্গে। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দৌঁড়ে উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশের দোকানে অবস্থানরত গ্যাংয়ের অন্য সদস্যদের খবর দেয়। তারা ব্যাগে করে দেশীয় অস্ত্র রামদা নিয়ে আসে। ব্যাগ থেকে রামদা বের করেই মেহেবুল ও নাসরিনকে কোপানো শুরু করে।

এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, দুই সন্ত্রাসী রামদা দিয়ে মেহেবুলের ওপর হামলা করছে। এসময় নাসরিনকে বারবার হাত জোড় করে স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইতে দেখা যায়। পরে নাসরিনের চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। তারা মেহেবুল ও নাসরিনকে উদ্ধার করেন এবং ধাওয়া দিয়ে দুই সন্ত্রাসীকে আটক করে পিটুনি দেন।

ঘটনাস্থলের পাশের এক দোকানদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ২৮ নম্বর রোডে দেখবেন একটা স্কুল আছে, স্কুলের পাশ দিয়ে কতগুলো দোকান বসছে। ওই দোকানগুলোতে এরা (কিশোর গ্যাং) বসে আড্ডা দেয়। ওদের কাজই এই। অনেকগুলো পোলাপান এক সঙ্গে হয় আর এভাবে মানুষদের ধরে ছিনতাই করে।

দোকানদার বলেন, “এই রাস্তা দিয়ে ওরা (ভুক্তভোগীরা) রিকশায় করে যাচ্ছিল। এক রিকশায় দুইজন, অন্য রিকশায় একজন বাচ্চাসহ দুইজন। দুই রিকশায় মোট চারজন। এরপর সন্ত্রাসীরা উচ্চ শব্দ করে তিনটা মোটরসাইকেল নিয়ে আসছে। এই জায়গায় আইসা রিকশার পেছনে মোটরসাইকেল বাধায় দেছে। এরপর বিশাল একটা শব্দ হইছে। বাচ্চাসহ রিকশায় যে ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন তিনি নেমে ওদের বলছে, ‘এটা একটা অভিজাত এলাকা। এখানে তোমরা এভাবে মোটরসাইকেল চালাও কেন?’ বাচ্চা ডরাইছে। পরে তারা রিকশা নিয়ে চলে গেছে।”
‘আরেক দম্পতির (মেহেবুল ও নাসরিন) রিকশা থেকে গেছে। এরাও এই রিকশা থেকে প্রতিবাদ করছে। পরে সন্ত্রাসীরা রিকশার দম্পতিদের গালি দিছে। রিকশা থেকে দম্পতিরা নেমে বলছে এই তোরা কি বললি? পরে সন্ত্রাসীরা তাদের ক্ষমতা দেখাতে বিভিন্ন জায়গায় ফোন দিছে। আর রিকশা নিয়ে এদের যেতে দেয় নাই। পরে ওই গেটের মধ্যে গিয়ে পোলাপানরা রিকশার ব্যাটারে থাপ্পর মারছে। তার আগেই তিনটা মোটরসাইকেল থেকে একটা চলে গেছে। পরে যখন ঝামেলা হচ্ছে তখন আমরা বাকি মোটরসাইকেলগুলো আটকাইছি। এটার একটা সমাধান করার জন্য। এরপর মহিলাও ওদের গেঞ্জি ধরে ওদের কয়েকটা মারছে। মারতে মারতে গেঞ্জি ছিড়ে দিছে। পরে গেঞ্জি ফেলায় রাইখা ওরা দৌড় দিছে। এরপর আরও কয়েকজন দৌড়ায় আসলে তাদের ধরে ফেলে। পরে দুইজনকে আগে পুলিশের কাছে দেয়নি। সেনাবাহিনী আসলে তাদের হাতে দিয়েছে।’

দোকানি জানান, কিশোর গ্যাংয়ের এই সদস্যরা এই রোডে সব সময় ছিনতাই করে। কিছুদিন আগে তার ছেলের মোবাইলও কেড়ে নিয়েছে।

যে বাসার সামনে হামলার ঘটনা ঘটে সেই বাসার কেয়ারটেকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি ওপরে ছিলাম। চিল্লাপাল্লা শুনে নিচে আসছি। এসে দেখি তাদের (মেহেবুল ও নাসরিন) কোপাচ্ছে। মহিলাটা লোকটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। তখন তার হাতে কোপ লাগে। আর সন্ত্রাসীরা ছিল চার থেকে পাঁচজনের মতো। দুইজনের হাতে দা ছিল। পরে গেট বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ছি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘটনাস্থলের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “পুলিশের গাড়িতে দুইজনকে (মোবারক হোসেন ও রবি রায়) ওঠানোর পরও ওরা পুলিশের সামনে সবাইকে হুমকি দিয়ে গেছে। তারা বলেছে, ‘কেডা কেডা আমাগো ধরছো, মারছো আমরা বের হয়ে তাগোরে কোপায় মারবো।’ এইভাবে পুলিশের সামনে বসে হত্যার হুমকি দিয়ে গেছে।”

তিনি আরও বলেন, উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশ উদাসীন, কিছু করে না।

ঘটনাস্থলের পাশে মেসের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা ওপরে ছিলাম। পরে দেখি এখানে চোর চোর বলে চিৎকার করছে। তারপরে আমরা বেলকনিতে আসলাম। দেখি দুইটা লোক একটা পুরুষ ও একটা নারীকে ধাওয়া দিয়ে নিয়ে এসেছে। তাদের হাতে রামদা ছিল। সেই রামদা দিয়ে পুরুষ আর নারীকে এলোপাতাড়ি কোপাচ্ছে। ৮-১০টা কোপ দিছে। নারীটা পুরুষটাকে সেফ করার চেষ্টা করছিল। পরে আমাদের হোস্টেল থেকে ছেলে-পেলে বের হয়ে এসে ওদের বাঁচায়।’

ঘটনাস্থলের পাশের ফ্ল্যাটের এক নারী বলেন, ‘ঘটনার শুরু হয়েছে মূলত মোটরসাইকেলের হর্ন বাজানো নিয়ে। তারপর তাদের যখন ধরা হয়েছে তারা হুমকি দিয়ে গেছে। এখানে দাঁড়িয়ে আমরা পুরো ঘটনা দেখেছি।’

তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যার পর থেকে এই রোডে (উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডে) তাদের গেদারিং শুরু হয়। তারা একটা গ্রুপ হয়ে এখানে থাকে। রাস্তায় দাঁড়ানো যায় না। আগে একটা দোকান ছিল এখানে, সেই দোকানের কারণে বেশি গেদারিং হতো। পরে সেই দোকানটা বন্ধ করে দিয়েছে। এখনও এদের বেশি উৎপাত হয় এই রোডের গেটগুলো খোলা থাকার কারণে।’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ওই নারী বলেন, ‘আমাদের কল্যাণ সমিতির যারা টহল দেয় তারা রাত ৯টা থেকে টহল শুরু করে। তার আগে কেউ থাকে না। তাছাড়া এই এলাকায় সিসি ক্যামেরা বা লাইট লাগানো হলে সেগুলোও সন্ত্রাসীরা তাদের সুবিধার্থে ভেঙে ফেলে। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক দোকান কর্মচারী বলেন, মোটরসাইকেলের হর্ন দেওয়া নিয়ে ঝামেলাটা হয়েছে। বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে এসে হর্ন দিচ্ছিল। একজন প্রতিবাদ করছে আর তার ওপরে চড়াও হয়েছে। রামদা এনে তাদের কুপিয়েছে।

হামলার পর উত্তরার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন মেহেবুল ও নাসরিন। তবে হাসপাতালে গিয়ে তাদের পাওয়া যায়নি। এছাড়া তাদের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

যোগাযোগ করা হলে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর বলেন, আহত দম্পতি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, তারা শঙ্কামুক্ত। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী নাসরিন আক্তার ইপ্তি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা রুজু করেছেন।

ওসি জানান, সরাসরি কোপ দেওয়া আফজাল নামের একজনসহ মোট তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার মোবারক হোসেনের গ্রামের বাড়ি শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলায়। তিনি টঙ্গী পূর্ব থানা এলাকায় ভাড়া থাকেন। আর রবি রায়ের বাড়ি টঙ্গী পশ্চিম থানাধীন হাজীর মাজার এলাকায়। গ্রেফতারকৃতদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। ঘটনায় জড়িত অন্যদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

jmitsolution_16012
© All rights reserved © 2025
Developed By : JM IT SOLUTION